প্রাণী চিকিৎষকের পেশাকে ভেটেরিনারী পেশা
(Veterinary Profession) বলা হয়ে থাকে। প্রাণী
চিকিৎষকদের সংক্ষেপে ভেট (Vet)-
এই ডাকনামে ডাকা হয়। আমরা হয়ত অনেকে এই পেশা সম্পর্কে খুব বেশি একটা জানি না।
বিশেষত কারো যদি কোন পোষা প্রাণী না থেকে থাকে কিংবা গৃহপালিত প্রাণী পালন করা না দেখে থাকেন, তার পক্ষে প্রাণী
চিকিৎষক সম্পর্কে না জানাটা খুবি স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আর মানুষ-প্রাণীর
সম্পর্কের গভীরতা জানা ব্যতিরেকে ভেটেরিনারী পেশার মাহাত্ম্য বুঝা কঠিন। মানুষ ও
প্রাণীর সম্পর্কও যে কত গভীর হতে পারে,
কত আবেগঘন হতে
পারে তা না দেখলে বুঝা দুষ্কর।
ধরুন, ছোট্ট একটি শিশু। সে কথা বলতে পারে না। আমরা যখন তাকে আদর করি,
সে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে তার শান্ত-মিষ্টি চাহনি আর নিষ্পাপ হাসি দিয়ে। তার এই
শব্দহীন অব্যাক্ত প্রতিক্রিয়ায় আমরা খুব আনন্দ বোধ করি এই ভেবে যে, সে আমাদেরকে
প্রত্যুত্তর দিচ্ছে আর আবেগি করছে। এই যে
নির্মোহ ভালোবাসার আদান-প্রদান, এতে কোন দেনা-পাওনার হিসেব নেই, আছে শুধু আবেগ আর
হৃদয় নিংড়ানো টান। পোষা প্রাণীর ক্ষেত্রেও পালক মানুষ সেই একি আবেগের সন্ধান পায়।
বোবা প্রাণীটি একটি ছোট্ট শিশুর মত অব্যাক্ত ভাষায় তার পালকের কাছে তার আবেগ
প্রকাশ করে, তার চাহনি দিয়ে খেলাচ্ছলে, কখনো বা তার পিছন পিছন ঘুরে বেড়িয়ে। পালক
মানুষটির যখন সারাদিনের কাজ শেষে ঘরে আসার সময় হয়, পোষা প্রাণীটি তার দুয়ারে
অপেক্ষার পালা গুনে বসে থাকে, ঠিক যেমনটি অপেক্ষা করে ঘরের প্রিয় মানুষটিও। যখন
কলিং বেলটি বেজে উঠে, সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে প্রিয় পালক মানুষটিকে সে সাদরে বরণ
করে নেয় এবং বোঝাতে চায় সারাদিন সে তাকে অনেক মিস করেছে! ঠিক একি ভাবে কোন কারণে
যদি বোবা প্রাণীটি দীর্ঘক্ষণ ঘরের বাইরে থাকে, পালক মানুষটির মন আনচান করতে থাকে-
কখন সে ফিরে আসবে! এতো কেবলি নিরেট শর্তহীন ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। এই সহজ সরল ভালোবাসার আদান-প্রদান মানুষ ও
প্রাণীর মধ্যে গড়ে তুলে এক অসাধারণ মেল-বন্ধন যার ভিত্তি হচ্ছে আবেগ।
আবার আপনি যদি কখন কোন গরু-ছাগল পালনকারী
কৃষক পরিবারকে পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে হয়ত দেখে থাকবেন-কি অদ্ভুত সুন্দর সম্পর্ক
পরিবারটির সাথে প্রাণীগুলোর। পরিবারের সদস্যরা কত আদর-যত্ন করে অবলা পশুগুলোকে।
পশুগুলোও যেন চেটেপুটে নেয় সেই আদরগুলো। এই যে মানুষ-পশুর মধ্যে ভাবের জন্ম, তার
স্বরূপ বুঝা যায় যখন কিনা কোন আর্থিক বিপদে পড়ে কৃষককে তার সাধের প্রাণীগুলোকে
বিক্রি করে দিতে হয়। বিদায়ক্ষণে রশি-টাকার অদল-বদলে কৃষকের চোখের কোনায় জমা হয়
বিষাদ-বিচ্ছেদের অশ্রুবিন্দু। এই যে মানুষ আর পশুর মধ্যেকার আবেগের অপূর্ব
মেল-বন্ধন – একে কখনো টাকার অঙ্কে মাপা যায় না।
তবে হ্যাঁ, আপনি যখন প্রানিসম্পদ নিয়ে
ব্যবসায় করবেন, তখন সেই আবেগের সাথে যুক্ত হয় আর্থিক সম্পর্ক। এই সম্পর্কটা ও
কিন্তু ফেলনা নয়। একজন দুধের খামারির কাছে একটা গরুর দাম-ই পরে এক-দুই লাখ টাকার
বেশি। একজন মুরগীর খামারির কাছে এক/দুইটা মুরগীর পালের দাম-ই হয় বেশ কয়েক হাজার
টাকা। এইসব ক্ষেত্রে এক-একটা প্রাণের ক্ষয় খামারিকে নিয়ে যেতে পারে সর্বস্বান্ত
হওয়ার পথে। এখানে আমরা দেখতে পাই, মানুষ- পশুর আবেগের সাথে শর্তযুক্ত ভালোবাসার সম্পর্ক
যার ভিত্তি হচ্ছে আর্থিক দিক।
এই আবেগ আর আর্থিক সম্পর্ক ছাড়াও মানুষ ও
প্রাণীতে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দিক আছে, যেটাকে বলে পরিবেশগত ভারসাম্য বা
Ecological Balance. সৃষ্টির সূচণালগ্ন থেকেই
প্রাণীরা এই পৃথিবীকে মানুষের বসবাস উপযোগী করে রাখতে নীরবভাবে একটি দুর্দান্ত
ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সাধারণ চোখে এই সম্পর্কটা খানিকটা অদৃশ্য বা প্রচ্ছন্ন
মনে হতে পারে। এই যেমন ধরুন, কেঁচোর কথা। কেঁচোকে প্রকৃতির লাঙল বলা হয় কেননা কেঁচো
প্রাকৃতিক উপায়ে মাটিকে উর্বর করে অধিক ফসল উৎপাদনে সাহায্য করে। তাই মাটিতে
কেঁচোর সংখ্যা অত্যধিক কমে গেলে তা খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে। আবার ধরুন,
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা যদি অস্বাভাবিকভাবে কমে যায় তাহলে হরিণসহ অন্যান্য তৃণভোজী
প্রাণীর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে বনের দূষণ বাড়বে আর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে।
এমনিভাবে আরো অনেক ভাবে মানুষ ও প্রাণী ওতপ্রোতভাবে গভীর সম্পর্কে জড়িত।
এই বিভিন্নমুখী ব্যাখ্যাগুলো বিবেচনায়
নিলে আমরা মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে অসাধারণ একটি সম্পর্কের চিত্রকল্প খোঁজে পাই। এই
সম্পর্কের ধরণ যায় হোক না কেন, আজকের এই আধুনিক যুগে এসেও মানুষ-প্রাণীর সম্পর্কের
কোন একটা দিককে অস্বীকার করার জো নেয়।
এখন আমরা যদি একটু খেয়াল করি, এই অবলা
প্রাণীগুলোও কিন্তু রক্তে-মাংসে গড়া যারা মানুষের মতই সময়ে-অসময়ে অসুখে-বিসুখে
পড়ে। তাদেরও আছে বিভিন্ন প্রাণঘাতী ব্যাধি। কিন্তু তারা তো আর মানুষের মত করে বলতে
পারে না! তারা যে বাকহীন, অবলা! এই রকম বাকহীন অবলা প্রাণীর সেবাকর্মে আত্মনিয়োগ
নিয়োগ করে এক প্রাণবন্ত ও উদার ভূমিকা পালন করেন ভেটেরিনারি ডাক্তাররা। পৃথিবীর
কেউ যদি অবুজ প্রাণীটির ভাষা বুঝতে না পারে,
তবে একজন প্রাণী
চিকিৎসক-ই পারে তা বুঝতে, তার সেবায় নিজেকে নিয়োগ করতে। নতুবা কত আবেগের যে হৃদয় বিদারক বিসর্জন হতো,
কত খামারি যে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো আর কতভাবে যে পরিবেশের নীরব বিপ্লব হয়ে
যেত তার ইয়ত্তা নেই।
সেই ভেটদের প্রতি শ্রদ্ধ্যা জানাই এজন্য যে,
তারা স্বেচ্ছায় এমন একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নেন। আর সারা বিশ্ব জুড়েই প্রাণী চিকিৎসকরা তাদের অসামান্য
অবদানের জন্য অত্যন্ত সমাদৃত। কারণ সবারই উপলব্ধি, “প্রাণী শুধু প্রাণী নয়, তারা আমাদের মানবজাতিরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ”।
এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আজাদি পত্রিকায়, মার্চ ৩০, ২০১৯
অসাধারণ লেখা৷ কৃৃৃৃৃতজ্ঞতা জানাই আপনাকে৷
ReplyDeleteSalute to you. Nice article.
ReplyDelete