Skip to main content

শিশুর প্রকৃত শিক্ষা এবং মূল্যবোধের বিকাশে মা-বাবার ভূমিকা

সম্প্রতি এক আত্মীয়ার কাছে শুনলাম প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় উনি এক রাতে জ্ঞান হারিয়ে নাকি হসপিটালে ভর্তি হন। কারণ জানতে চেয়ে শুনলাম পরের দিন তার সন্তানের পিএসসি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছিল তাই উনি দুশ্চিন্তায় উচ্চ রক্ত চাপের শিকার হয়ে জ্ঞান শূন্য হয়ে জান। ঘটনাটি শুনে আমার আরেক আত্মীয়া বলে উঠলেন, ‘ও কি এসএসসি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে যে কারণে ওকে এত দুশ্চিন্তা করতে হবে!!!’ ভাগ্য সহায় ছিল যে এই সব কথাবার্তা শুনে আমার জ্ঞান লোপ পাই নি সেদিন, তবে অন্যরকম দুশ্চিন্তা আমার মাথায় ভর করে যে কারণে আজকের এই লেখা।

উপরের ঘটনাটি মোটেও বানিয়ে বলা নয়। এই ছোট্ট ঘটনাটি আমাদের সমাজের একটি বড় ব্যাধির খন্ড চিত্র মাত্র। আমাদের বর্তমান সমাজের বাবা-মা সন্তানের ভালো চেয়ে অনেক সময় তাদের সাংঘাতিক পরিমাণে ক্ষতির মুখে ফেলে দিচ্ছেন অজান্তেই। বিষয়টি আমি ব্যাখ্যা করে বলছি। আশা করছি মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।

PC: Google Image
বেশিরভাগ পরিবারেই লক্ষ্য করা যায় ছোট ছেলেমেয়েদের অনেক বেশি চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে পড়ালেখার জন্য। প্রায়শ দেখা যাই বাবা-মায়েরা নিজের ছেলে মেয়েকে অন্যের ছেলে-মেয়ের সাথে তুলনা করে যাচ্ছেন যা বাচ্চাদের উপর প্রচণ্ড রকম মানসিক চাপ তৈরি করে থাকে। কথায় কথায় তোলা হয় রেজাল্টের কথা, প্লেসে থাকার কথা। আসলে ব্যাপারটি কি এমন হওয়ার কথা ছিল? পড়ালেখা বিষয়টাকে আমরা ভিন্ন এক উচ্চতায় তুলে নিয়েছি- যে উচ্চতার কোন ভিত্তি নেই- অর্থ নেই। সেই উচ্চতায় সবকিছু চিন্তা করা হয় আর সফলতা মাপা হয় রেজাল্ট, জিপিএ, প্লেস আর কোন স্কুলে পড়লো তার ভিত্তিতে। এসব বিষয় নিয়ে বাবা-মায়েরা রীতিমত অহংকার বোধ করেন এবং চান প্রতিটি ছেলেমেয়ে তাদেরকে এই অহংকারের শিরোপা এনে দিবেন যাতে তা তারা সবাইকে বলে নিজের মুখ রক্ষা করে  আনন্দিত হতে পারেন। নিজেকে একজন সুখী এবং সফল মা-বাবা বলে পরিচয় দিতে পারেন। দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। ছেলে-মেয়ে ভালো করলে বাবা-মা হিসেবে অবশ্যই ভালো লাগবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন আমরা এই ভালো রেজাল্ট করাটাকেই সফলতার একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে নিয়ে নেই। যে কারণে যারপরনাই হয়ে বাচ্চার উপর অবিরত চাপ প্রয়োগ করতে থাকি। আমরা হয়ত ভাবি এই রেজাল্ট তাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে, তাকে সফল করবে। আসলে কি তাই?

আমরা ভুলেই যায় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য রেজাল্ট বা সার্টিফিকেট অর্জন করা নয়। বরং শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য মানবিক গুণে গুণান্বিত হওয়া, নিজের চিন্তাশক্তিকে বিস্তৃত করা আর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা শেখানো।  এই ক্ষেত্রে আপনার উচিত হবে বাচ্চাকে নতুন নতুন বিষয় জানার জন্য-জ্ঞানের ভিত্তি তৈরির জন্য উৎসাহিত করা।  কিন্তু আমরা যখন শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যগুলো ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র রেজাল্টের পিছনে দৌড়ায়,  তখনি ভুল পথে পা বাড়ায়। আমি বলছি না ভাল রেজাল্ট একবারেই গুরুত্বহীন বা ভালো স্কুলের কোন ভূমিকা নেই। তবে মরে রাখতে হবে এগুলো অর্জন করার মধ্যেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নিহিত নয়। জীবনটা এর চেয়ে অনেক বড় কিছু যেখানে মানুষকে জ্ঞান গ্রহণের পাশাপাশি মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধগুলো অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  এই মানবিক মূল্যবোধ গুলো শিশুকে শিখাবে কোন কাজটি খারাপ আর কোনটি ভালো, একজন ভালো মানুষের গুণগুলো কি কি, ছোট-বড়-পরিচিত-অপরিচিত সব মানুষকে কিভাবে শ্রদ্ধা করতে হয়, নীতি- নৈতিকতা কি, সমাজের আশেপাশের লোকজন/ আত্মীয়স্বজনদের/দেশের প্রতি আমাদের করণীয় কি, ধর্মচর্চা কি, পারিবারিক বন্ধন কি এবং আরও অনেক কিছু। বাচ্চা এই সব কিছু ঠিকঠাক মত শিখছে কিনা সে বিষয়ে বরঞ্চ আমাদের অনেক বেশি সজাগ থাকা উচিত। যদিও এইসব শিখানো প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা অন্যতম দায়িত্ব, কিন্তু তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি দায়িত্ব পরিবারের- বাবা-মা হিসেবে। আপনি কি একবার ভেবে দেখেছেন আপনার সন্তান যদি জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হয় কিন্তু মানবিক ও সামাজিক গুণগুলো অর্জন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার ভবিষ্যৎ জীবন কেমন হতে পারে।

অনেক পরিবারে হয়ত এই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই- তাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে, ভালো স্কুল/শিক্ষকের কাছে পড়িয়ে, ভালো রেজাল্ট করিয়ে হয়ত মনে করছেন সব দায়িত্ব শেষ। কিন্তু আসলে তা নয়, যে কারণে অনেক বাচ্চারা আজ অল্প বয়সে বিগড়ে যাচ্ছে। আমার এই কথাগুলো খুব কর্কশ শোনালেও এগুলো হচ্ছে সমাজ বাস্তবতা। কিন্তু এই বাস্তবতার কোন ইতিবাচক সমাপ্তি নেই- রয়েছে ভয়ংকর কিছু পরিণতি যা আমরা প্রায়শ পত্রিকার পাতা উল্টালে বা সমাজের আশেপাশে তাকালে দেখতে পাই। বাচ্চা বয়সে অনেক ছেলে-মেয়েরা উগ্র মেজাজ দেখাচ্ছে, সামান্য অপ্রাপ্তিতে আত্মহত্যার মত পথ বেছে নিচ্ছে, একগুঁয়ে হয়ে যাচ্ছে, প্রচণ্ড অস্থিরতা দেখাচ্ছে সব ক্ষেত্রে, মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে, অন্যের সাথে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করছে, তথাকথিত সফল হওয়ার জন্য অসদোপায় অবলম্বন করছে, স্বাভাবিক সামাজিক ব্যবহার করছে না এবং আরো নানাবিধ অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এই ছেলেমেয়েদের অনেকে বড় হয়ে এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। এখানে শিক্ষকতা করতে গিয়ে অনেক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই অস্বাভাবিকতা খুব স্পষ্টভাবে আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক বেশি দেরি হয়ে যায় এই সমস্যাগুলোর প্রতিকার করতে যেটা বাচ্চা বয়সে অনায়াসে করা যায়। আসলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বয়সে তাদের নিজস্ব চিন্তা চেতনার জায়গা তৈরি হয়- এসময় নতুন করে মূল্যবোধ শেখানো কঠিন হয়ে পড়ে। এবং খুব সংগত কারণেই তাদের এই অস্বাভাবিকতা বয়ে চলে আজীবন। আপনি কি একবার ভেবে দেখেছেন কোন ছেলেমেয়ে গুলো বৃদ্ধ বাবা-মা বা শশুড় শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে? ওই সব প্রথম হওয়া, ভালো স্কুলে পড়া কিন্তু মানবিক-সামাজিক মূল্যবোধ না শেখা শিশুগুলো নয়ত!



মোকাদ্দেস আহমেদ দিপু
সহকারী অধ্যাপক
কৃষি অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞান
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)

এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আজাদি -তে জানুয়ারি ৬, ২০২০ তারিখে

Comments

Post a Comment